শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৬ অপরাহ্ন
ক্রাইম সিন ডেস্ক:একাধিক লাশ হলেই লাশকাটা ভবনের সামনের সড়কে ফেলে রাখা হয়। ময়নাতদন্ত চলাকালীন সময় একাধিক লাশ নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় পুলিশ ও স্বজনদের। ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের জড়াজীর্ণ লাশকাটা ঘরে জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে ময়নাতদন্তের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছেনা।
হয়রানী হতে হচ্ছে লাশ নিয়ে আসা স্বজনদের। লাশকাটা ঘরের জড়াজীর্ণ ভবনের সামনে ২০২০ সালে দুই কক্ষের একটি নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করে গনপূর্ত বিভাগ। কিন্তু বরাদ্দ না থাকায় সে কাজও বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে ময়নাতদন্তের জন্য ব্যবহৃত ওজন মাপার যন্ত্র, ছুড়ি ও কুড়ালসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংকট রয়েছে।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে চাহিদা পাঠানোহলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ মিলছেনা। ২০১৭ সালে লাশকাটা ঘরের সাবেক ডোম দিলিপ ভক্ত সেচ্ছায় চাকুরি ছেড়ে চলে যান। সেই থেকে গত ৫ বছর পর্যন্ত পদটি শূন্য রয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরীর পদটি শুরু থেকেই শুন্য।
সাংসদ আমির হোসেন আমুর নিজস্ব তহবিল থেকে ১৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে পলক নামের একজন ডোম লাশকাটা ঘরে কাজ করছেন। তাঁকে কাজে সহায়তা করছেন ভাই অমিত ডোম।
সম্প্রতি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রথমে ৩৬ জনের পরেও আরও ৫ যাত্রীর লাশের ময়নাতদন্ত হয় এই লাশকাটা ঘরে।
লাশকাটা ঘরটির ইতিহাসে এই প্রথম এক সাথে এত লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। মর্গে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সড়কের পাশেই লাশগুলো স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে গত ৫ বছর পর্যন্ত অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন পলক ডোম (২৬)। এই প্রথমবারের মত লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত একসাথে ৩৬টি লাশের ময়নাতদন্ত করে হিমশিম খেয়ে যান পলক ও তাঁর ভাই অমিত ডোম (৩০)।
কোনো মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে সাধারণত দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে এখন লাগছে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। আর এ কারণে লাশকাটা ঘরের সামনে স্বজনদের ভিড় লেগেই থাকে।
দুর্গন্ধে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় এলাকাবসিকেও। ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সনে ঝালকাঠি শহরের চাঁদকাঠি ব্র্যাকমোড়ের গাজী বাড়ী এলাকায় এককক্ষ বিশিষ্ট একটি ভবনে লাশকাটাঘর স্থাপন করা হয়। সেই থেকে জড়াজীর্ণ এ ছোট ভবনেই মৃতদেহের ময়নাতদন্তের কাজ চলছে।
দীর্ঘদিনধরে ময়নাতদন্তের জন্য ব্যবহৃত ওজন মাপার যন্ত্র, ছুড়ি ও কুড়ালসহ সব সরঞ্জামের সংকট রয়েছে। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাতে চোরের দল দরজা ভেঙ্গে নতুন এক সেট যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে যায়।
ভিতরে থাকা স্ট্রেচারগুলোতেো মরিচা ধরে আছে। কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও লাশ রাখার হিমাগারের কোন ব্যবস্থা নেই।
লাশ রাখার ফ্রিজটি বছর খানেক ধরে বিকল। ফলে সংরক্ষণে ব্যবস্থা না থাকায় রাতে নিয়ে আসা লাশের পচন ধরার আশঙ্কা থাকে।
নিয়ম অনুযায়ী বিকেল ৫টার পর থেকে সকাল না হওয়া পর্যন্ত কোন লাশের ময়নাতদন্ত হয়না।
অপরদিকে ফরেনসিক প্রতিবেদনের জন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঢাকায় পাঠাতে হলে রাসায়নিক পদার্থ ফরমালিনের প্রয়োজন হয়।
পচন ঠেকাতে কৌটায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভরে ফরমালিন দিয়ে ঢাকায় পাঠাতে হয়। লাশকাটা ঘরে সেই ফরমালিন হাসপাতাল থেকে সরবরাহ না করায় মৃত ব্যক্তির স্বজনদের তা আলাদা কিনতে হয়। এজন্য তাঁদের তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হয়। আবার ডোম অস্থায়ী হওয়ায় তাঁকে খুশি করতেও এক থেকে দেড় হাজার টাকা দিতে হয়।
এ বিষয়ে পলক ডোম বলেন, গত ৫ বছরেও আমার ডোমের পদটি স্থায়ী হয়নি। সাংসদ আমির হোসেন আমুর অনুদানে আমাদের সংসার চলছে। লাশ কাটা-ছেঁড়ার যন্ত্রাংশসহ ফ্রিজ না থাকায় লাশ পঁচে যাওয়ার ভয় থাকে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় লাশকাটা ঘরের পিছনের দিকে রয়েছে গুরুধাম খাল। সেখানে লাশের পরিত্যাক্ত অংশ এবং রক্ত ফেলা হয়। যা থেকে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ এবং নষ্ট হচ্ছে খালের পানি।
স্থানীয় বাসিন্দা সুকমল ওঝা বলেন, বাসা কোথায় কেউ জানতে চাইলে লাশ কাটা ঘরের পাশের পরিচয় দিতে হয় আমাদের। হাসপাতালে লাশ কাটার জন্য নির্ধারিত কক্ষ থাকলেও সেটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমাদের সন্তানরা লাশকাটা ঘরের পাশ থেকে যাতায়াত করতে ভয় পায়। তাদের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঠিকাদার মাহাবুবুর রহমান তালুকদার বলেন, নতুন লাশকাটা ঘরের কাজ আগামী দুই মাসের মধ্যে শেষ করা হবে।
ঝালকাঠি গনপূর্ত বিভাগের উপ সহকারি প্রকৌশলী সমরজিত সিং বলেন, গত সপ্তাহে কিছু বরাদ্দ এসেছে। ঠিকাদারকে দ্রুত কাজ শেষ করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) আমির হোসাইন বলেন, সদর হাসপাতালে বহুতল ভবন নির্মাণ শেষ হলে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য সেখানের কোনোকক্ষ বরাদ্দ থাকবে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও ফ্রিজের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদা পঠানো হয়েছে। ডোমের শূন্য পদেও শিগগিরই নিয়োগ দেয়া হবে।